হ্যানয় থেকে লিখছি :
– আবু তাহের
সোসাল রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম। লোক সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৯ কোটি। জনসংখ্যার দিকে বিশ্বের ১৪তম দেশ। রাজধানী হ্যানয়। বিখ্যাত এই শহরে নেমে প্রথমে দেখতে গিয়েছি হু চি মিন মিউজিয়াম। এখানে ‘বা দিন স্কয়ারে’ এই বিপ্লবীর মরদেহ রক্ষিত রয়েছে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য। অবশ্য আমার দেখা হল না এই মহান পুরুষকে। কারণ নির্ধারিত সময়ের পরে সেখানে উপস্থিত হয়েছি। তাই ভিতরে যাওয়ার সুযোগ না হলেও মিউজিয়ামের অন্যান্য অংশ দেখে অনেকটা সময় কাটিয়েছি এখানে। ভিয়েতনাম সরকার তদের বীরকে সম্মান জানানোর জন্য বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তুলেছে হু চি মিন মিউজিয়াম।
মিউজিয়াম ঘুরে যা জেনেছি- ভিয়েতনামের বীর যোদ্ধা হু চি মিন ১৮৯০ সালের ৯ মে জন্ম গ্রহণ করেন। ছাত্র অবস্থায় সমাজ কর্মের সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এরপর যুক্ত হন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। তখন ফ্রান্সের কলোনী ছিল ভিয়েতনাম। ফ্রান্স সরকার তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করেন। তিনি সাইগন-এ (তখন উত্তর অংশের রাজধানী) রেস্টুরেন্টে কিচেন হেলপার হিসাবে চাকুরি শুরু করেন। এরপর ছোট্ট এই চাকুরি নিয়ে আমেরিকার নিউইয়র্ক, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স যান। বিদেশে পড়ে থাকলেও হু চি মিন দেশের জন্য কিছু করার চিন্তা মনে লালন করতে থাকেন। পরে তিনি চলে যান সোভিয়েত রাশিয়ায়। সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নেন। ১৯৪১ সালে দেশে ফিরে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করেন হু। ১৯৪৫ সালের আগস্ট বিপ্লবের পর হু চি মিন দলের পক্ষে বিভিন্ন
দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর হু চি মিন ভিয়েতনামের স্বাধীনতার পক্ষে ঘোষনাপত্র পাঠ করেন। শুরু হয় দখলদার ফ্রান্সের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই। ১৯৫৪ সালে উত্তর ভিয়েতনাম এর দখল নেয় হু চি মিন এর নেতৃত্বে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম পার্টি। ভিয়েতনামের দু’টি অঞ্চল হচ্ছে উত্তর অর্থাৎ হ্যানয় এবং অপরটি দক্ষিণ অর্থাৎ সাইগন। উত্তরের শাসন পেলেও দক্ষিণের শাসন কার্যত তখনও ছিল ফ্রান্সের হাতে। ১৯৫৭ সালে আমেরিকা সৈন্য সমাবেশ করে দক্ষিণ ভিয়েতনাম-এ। শুরু হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ। যুদ্ধে ‘অপারেশন রুলিং থান্ডার’ নামের অভিযানে ব্যাপক গণহত্যার অভিযোগ উঠে আমেরিকার সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে। হু চিন মিন এর নেতৃত্বে ভিয়েতনাম পিপলস আর্মি আমেরিকার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল তাঁর মৃত্যুর ৬ বছর পর (৩০ এপ্রিল ১৯৭৫) তা শেষ হয়। শক্তিশালী আমেরিকান বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে ভিয়েতনামের গেরিলা বাহিনী। এক হয় ভিয়েতনামের উত্তর ও দক্ষিণ অংশ। দক্ষিণ অংশ সাইগন নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ হয় তাদের বিপ্লবী বীর হু চি মিন এর নামে। ইতিহাস বলে ভিয়েতনাম যুদ্ধে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে। এই যুদ্ধে ৯ লক্ষ ৬৬ হাজার ভিয়েতনামী মানুষ আতœত্যাগ করেছেন। দীর্ঘ এই যুদ্ধে প্রায় ৫৮ হাজার আমেরিকান সৈন্যও মারা যায় ।
ভিয়েতনামের স্বাধীনতার জনক হু চি মিন ১৯৬৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর হ্যানয় এর বাসভবনে সকাল ৯ টা ৪৭ মিনিটে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। এই বিপ্লবীর মরদেহ এখন রক্ষিত রয়েছে ‘বা দিন স্কয়ারে’ হু চি মিন মিউজিয়ামে। ভিয়েতনামের ইতিহাস লিখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আগেই বলেছি রাজধানী হ্যানয় শহরে প্রথমেই দেখতে গিয়েছি হু চি মিন মিউজিয়াম। এখানে ‘বা দিন স্কয়ার’ এমন ভাবে সাজানো হয়েছে হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন তা পরিদর্শন করতে আসছে। ভিয়েতনামের দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্রের একটি এটি।
হ্যানয় শহরে আমি যে এলাকায় উঠেছি তার নাম ‘ওল্ড কোয়ার্টার’। আসলে সব কিছু পুরানো এখানে। অলিগলি সরু। অনেকটা আামাদের পুরান ঢাকার মত। তারপরও বিদেশী পর্যটকরা এই এলাকাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। তার কারণ মনে হয় এই এলাকাটি রাতে বেশ জমজমাট হয়ে উঠে। দিনের বেলায় দেখেছি এখানে সড়কের উপর বাজার বসে। মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আসে। মাছ মাংস তরিতরকারি থেকে নানা ফলমূল সবই পাওয়া যায়। আর রাতে সেই সড়কের উপর বসে খাবারের দোকান। রাস্তার উপর টুল পেতে দেয়া হয়। স্থানীয়দের সাথে বিদেশী পর্যটকরা এই টুলের উপর বসে খাবার ও পানীয় নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠে। অনেক দুর দুরান্ত থেকে খাওয়ার জন্য ওল্ড কোয়ার্টার এলাকায় চলে আসে স্থানীয়রা। এখানে খাবার বেশ সস্তা। পানীয় তার চেয়েও কম। তাই বিদেশী পর্যটকের জন্য বেশ পছন্দের এই স্থান। ওল্ড কোয়র্টারে দেখেছি দিনের বেলায় যে মুদি দোকান বা অন্য কোন ব্যবসা নিয়ে জমেছিল, রাতে সেটি খাবারের দোকানে রূপ নিয়েছে। দোকানের সামনে রাস্তার উপর টুল পেতে ভোজনরসিক ক্রেতাদের বসার ব্যবসা করা হয়। তখন সড়কসমূহে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত চলে জমজমাট এই ব্যবসা।
একটি পর্যটন কেন্দ্রে রাতের বিনোদন ব্যবস্থা না থাকলে পর্যটক আকর্ষন হয় না। পৃথিবীর সব নামকরা পর্যটন কেন্দ্রে ‘নাইট লাইফ’ বা রাতের ব্যবস্থাকে অতি গুরুত্ব দেয়া হয়। আমার শহর কক্সবাজারে কেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কর্তাদের মাথায় ঢুকে না বুঝি না। বারবার বুঝাতে চেষ্টা করেছি পরিকল্পনাতেই থাকে কেবল। কেউ রাতের বাজার বসানোর চেষ্টা করলে ময়লা (তাদের ভাষায়) পরিস্কার করা হয় অভিযান চালিয়ে। না হচ্ছে কর্মসংস্থান, হচ্ছে না পর্যটন। দীর্ঘ সৈকতের অহংকার নিয়ে শুধু বসে আছি। বিদেশীর কোন দেখা নেই। এখানে শুধুমাত্র ওল্ড কোয়ার্টার এলাকাতেই দেখেছি হাজার হাজার পর্যটক। পর্যটন খাত থেকে ভিয়েতনাম কি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে সহজে অনুমান করা যায়।
হ্যানয় শহরে ওল্ড কোয়ার্টারের পাশেই আরেকটি পর্যটন কেন্দ্র ‘হুয়ান কিয়েম লেক’। আমাদের কাপ্তাই বা রাঙ্গামাটি লেকের ধারে কাছেও হবে না এর সৌন্দর্য। তবুও এখানে পর্যটকে গিজগিজ করছে। হাঁটার জায়গা পাওয়া মুসকিল। ‘হুয়ান কিয়েম’ অর্থ হচ্ছে ফিরে আসা তরবারি। এই লেক নিয়ে কথিত আছে ১৪২৮ সালে স¤্রাট লি লুই নৌকায় এই লেক দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন এক দেবতা কচ্ছপ রূপ নিয়ে এসে সম্্রাটকে স্বর্ণের তৈরি একটি তরবারি উপহার দেন। সেই তরবারি নিয়ে যুদ্ধ করে স¤্রাট চীনাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। পরে সেই তরবারি দেবতাকে ফেরত দেন স¤্রাট। আর লেকটির নামকরণ করেন ‘হুয়ান কিয়েম লেক’ নামে। আগে এর নাম ছিল ‘সবুজ পানি’ নামে। লেকের মধ্যস্থানে ছোট্ট একটি দ্বীপে স্থাপিত মন্দিরে কচ্ছপের দেবতাকে প্রতিষ্টিত করেছেন স¤্রাট লুই। হাজার হাজার দশনার্থী মন্দিরে গিয়ে কচ্ছপ দেবতার প্রতি তাদের ভক্তি জানাচ্ছেন। বিদেশী পর্যটকরাও টিকেট কেটে মন্দির পরিদর্শন করছেন।
হ্যানয় শহরে আর একটি জিনিষ আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। তা হচ্ছে রিকসা। আমাদের রিকসার সাথে এর তফাৎ- এখানে চালকের সিট পেছনে। যাত্রী বসেন সামনে। এই শহরে পর্যটকদের জন্য বেশ আকর্ষনীয় বাহন রিকসা। রিকসার ভাড়া ঘন্টায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডং (ভিয়েতনামী মুদ্রা)। আমাদের টাকায় প্রায় ৫’শ টাকা। স্থানীয়রা এই রিকসায় উঠে না। তাদের জন্য কম মূল্যের বাহন হচ্ছে মটর সাইকেল। হাজার হাজার লোক এখানে মটর সাইকেল ড্রাইভার হিসাবে কাজ করছেন। ঘন্টায় এক’শ দেড়শ টাকা ভাড়ায় এখানে ড্রাইভার সহ মটর সাইকেল পাওয়া যায়। হ্যানয়কে মটর সাইকেলের শহরও বলা যায়। অফিস শেষ হলে দেখেছি সড়কে মটর সাইকেলের দীর্ঘ মিছিল। এই দৃশ্য আমার জন্য অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা।
তিন লক্ষ ডং দিয়ে দুই ঘন্টার জন্য একটি রিকসা ভাড়া করে শহর দেখতে বের হয়েছি। রিকসা ড্রাইভার তাং কে বললাম- আমার দেশেও রিকসা আছে। তবে এই রিকসায় চালক বসেন সামনে। মনে হল তিনি বিশ্বাস করলেন না আমার কথা। কেন বিশ্বাস হচ্ছে না জানতে চাইলে তাং বললেন- যাত্রী হচ্ছে অতি সম্মানিত মেহমান। তিনি কিভাবে পেছনে বসবেন? তাং এর অবিশ্বাসের কারণ এবার বুঝতে পারলাম। তাদের কাছে পর্যটক মানেই দেবতা- অতি সম্মানিত মেহমান। সুতরাং এই সম্মানিত যাত্রী কিভাবে চালকের পেছনে বসবেন। সামনেই তাঁর আসন হতে হবে। তাং আমার দেশের রিকসা নিয়ে রসিকতা করে জানতে চাইলেন- ‘চালক যদি বায়ু নির্গত করেন, তাহলে সম্মানিত মেহমানের কি অবস্থা হবে’? সেই উত্তর এড়িয়ে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গ ধরলাম।
এখানে মুদ্রা নিয়ে বেশ খোশ মেজাজে আছি। খরচের ক্ষেত্রে নিজেকে মোগল সম্রাট বলে মনে হচ্ছে। সড়কের পাশে টসটসে পাকা আমড়া নিয়ে বসেছেন এক বৃদ্ধা। সাইজেও বেশ বড়। আমাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন একটি ক্রয় করার জন্য। দু’টি আমড়া কিনলাম ১০ হাজার টাকা (ডং) দিয়ে। আমি যে হোটেলে উঠেছি প্রতি রাতের জন্য তার ভাড়া প্রায় ১০ লক্ষ ডং। একশ ডলার ভাঙ্গিয়ে এখানে পেয়েছি ২২ লক্ষ ৮০ হাজার ডং। সুতরাং খরচ করছি লাখ লাখ। নিজেকে মোগল সম্রাট না ভেবে কি উপায় আছে।
♦ এই লিখা নিয়ে কোন মন্তব্য থাকলে ই-মেইল করতে পারেন।
## ছবি ক্যাপশন – হ্যানয় শহরে হু চি মিন মিউজিয়াম এর সামনে লেখক।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।